দারসুল হাদিসঃ হযরত আবু দারদা রাঃ বর্ণিত আলেমের মর্যাদা


 

আরবীঃ

وَعَن أَبي الدَّردَاءِ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُمَنْ سَلَكَ طَرِيقاً يَبْتَغِي فِيهِ عِلْماً سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقاً إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ المَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا لِطَالِبِ العِلْمِ رِضاً بِمَا يَصْنَعُ وَإِنَّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتَّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ وَفَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِ القَمَرِ عَلَى سَائِرِ الكَوَاكِبِ وَإِنَّ العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا العِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بحَظٍّ وَافِرٍرواه أَبُو داود والترمذي

অনুবাদঃ

আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে, যাতে সে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতাবর্গ তালেবে ইলমের জন্য তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলি বিছিয়ে দেন। অবশ্যই আলেম ব্যক্তির জন্য আকাশ-পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আবেদের উপর আলেমের ফযীলত ঠিক তেমনি, যেমন সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ফযীলত। উলামা সম্প্রদায় পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোন রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানভান্ডারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পর্যাপ্ত অংশ লাভ করল।

[গ্রন্থ সুত্রঃ জামি আত তিরমিযী- ২৬৮২, সুনানু ইবনে মাজাহ- ২২৩, হাদীস শরীফ; ১ম খন্ড]

রাবী পরিচিতিঃ

নাম : ওয়াইমির।

উপনাম : আবু দারদা।

উপাধি : হাকীমুল উম্মাহ৷

স্ত্রীর নাম : খায়রা । যিনি উম্মে দারদা নামে প্রসিদ্ধ।

আবু দারদার মেয়ের নাম দারদা। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী সন্তানের নামানুসারে আবু দারদা ও উম্মে দারদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আবু দারদা ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের বিশিষ্ট আনসারী সাহাবী।

কর্মজীবন : আড়ম্বরহীন জীবনের অধিকারী এই মহান সাহাবী উত্তম চরিত্র, দয়া, অতিথিপরায়ণতা, মানবহিতৈষী প্রভৃতি সৎগুণের আধার ছিলেন। ফেকহ ও হাদীস শাস্ত্রে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্ব ছিল । রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর দক্ষতা ছিল বেশ। হযরত ওমর ও হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার শাসনামলে তিনি সিরিয়ার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কোথাও সফর করার সময় তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ার বিচারপতি হয়েছিলেন।

তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা : হযরত আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাস থেকে ১৭৯ টি হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বুখারীতে ১৩টি হাদীস এবং ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুসলিম শরীফে ৮টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। “যাখায়িরুল মাওয়ারিস” নামক গ্রন্থে আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদীসসমূহ সংকলিত করা হয়েছে।

মৃত্যু : জীবনের শেষের দিকে তিনি সিরিয়ায় বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের শেষ সময়ে ৩২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

গ্রন্থ পরিচিতঃ

জামি আত তিরমিযীঃ

জামি তিরমিযী তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযােগ্য গ্রন্থ। ইমাম তিরমিযী তাঁর এ গ্রন্থ খানা ইমাম আবু দাঊদ ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর অনুসৃত গ্রন্থ প্রণয়নরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথমত এতে ফিকহের অনুরূপ অধ্যায় রচনা করা হয়েছে। এতে ব্যবহারিক জীবনের প্রয়ােজনীয় হাদীস সমূহ সন্নিবেশিত করেছেন। সে সঙ্গে বুখারীর ন্যায় জীবন চরিত, শিষ্টাচার, তাফসীর, আকীদা-বিশ্বাস, বিশৃংখলা, বিপর্যয়, আহকাম, যুদ্ধ-সন্ধি, প্রশংসা ও মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ের হাদীসও সংযােজিত করেছেন। ফলে গ্রন্থখানি এক অপূর্ব সমন্বয়, এক ব্যাপক গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এ গ্রন্থের ‘জামি’ নাম সার্থক হয়েছে।

ইমাম তিরমিযী এতে বিভিন্ন বিষয়ের অতি প্রয়ােজনীয় হাদীস সমূহ সুন্দরভাবে সজ্জিত করেছেন। এজন্য হাফিয আবু জাফর ইবনু যুবাই ‘কুতুবুস সিত্তাহ’ সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, والترمذي في فنون الصناعة الحديثية مالم يشاركه غيره ‘ইমাম তিরমিযী ইলমে হাদীসে গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবিসংবাদিত”। ইমাম তিরমিযী তার এ গ্রন্থ প্রণয়ন সমাপ্ত করে তদানীন্তন মুসলিম জাহানের হাদীসবেত্তাগণের নিকট এটা যাচাই করার জন্য পেশ করেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, صفت هذا المسند الصحيح وعرضته على علماء الحجاز قرضوا به وعرضه على علماء خراسان فرضوا به‘আমি এ সনদযুক্ত হাদীছ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করে একে হিজাযের হাদীসবিদদের সমীপে পেশ করলাম। তারা এটা দেখে খুবই পছন্দ করলেন ও সন্তোষ প্রকাশ করলেন। এরপর আমি এ গ্রন্থকে খুরাসানের মুহাদ্দিসগণের খেদমতে পেশ করলাম। তারাও একে অত্যন্ত পছন্দ করেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন’।

ইমাম তিরমিযী তার সংগৃহীত পাঁচ লক্ষ হাদীসের মধ্য হতে মাত্র ১৬০০ হাদীছ নির্বাচন করে ‘জামে তিরমিযী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এতে ৪৬টি পর্ব এবং ২১১৪টি অধ্যায় আছে।

সুনানু ইবনে মাজাহঃ

ইমাম ইবনে মাজাহ (রহঃ) -এর দীর্ঘদিনের কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফসল সুনানু ইবনে মাজাহ। এটি সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি সংকলন শেষে ইমাম ইবনু মাজাহ (রহঃ) স্বীয় প্রখ্যাত উস্তাদ ইমাম আবু যুর আর-রাযীর নিকট পেশ করলে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণপূর্বক একে ইলমে হাদীসের এক অনন্য সাধারণ ও উপকারী গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেন। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনু মাজাহ (রহঃ) বলেন, عرضت هذه السنن على أبي زرعة فنظر فيه، وقال: أظن إن وقع هذا في أيدي الناس تعطلت هذه الجوامع أو أكثر هاء

‘আমি এ সুনান গ্রন্থটির সংকলনকার্য সমাপনান্তে আমার উস্তাদ আবু মুর’আ আর-রাযীর নিকট পেশ করলে তিনি সূক্ষভাবে নিরীক্ষাপূর্বক মন্তব্য করেন যে, আমি মনে করি এ সুনাল গ্রন্থটি জনসাধারণের হাতে পৌঁছলে বর্তমান পর্যন্ত সংকলিত সবগুলাে অথবা অধিকাংশ হাদীসগ্রন্থ অগ্ৰযােজনীয় হয়ে যাবে।

ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ:) লক্ষাধিক হাদীস যাচাই-বাছাই করে এ গ্রন্থটিতে মােট ৪৩৪১ টি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এর মধ্যকার ৩০০২ টি হাদীস এমন যেগুলাে পাঁচটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সবগুলােতে অথবা কোন কোনটিতে রয়েছে। এছাড়া ১৩৩১ টি হাদীছ ব্যতিক্রম। যেগুলাে সিহাহ সিত্তার অন্য পাঁচজন গ্রন্থকার বর্ণনা করেননি। এতে মােট ৩৭ টি অধ্যায় ও ১৫৪৫ টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।  হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, وثلاثين كتابا، وألف وخمسمائة باب، و على أربعة آلاف حديث ويشتمل على اثنين “এতে ৩২ টি অধ্যায়, ১৫০০ টি পরিচ্ছেদ এবং চার সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে’। 

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দ্বীনী ইলম শিক্ষার গুরুত্ব :

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। এ গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ তা‘আলা প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُوْنِيْ بِأَسْمَاءِ هَـؤُلاَءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- ‘আর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দোন। তারপর সেসমস্ত বস্ত্ত ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। অতঃপর আল্লাহ বলেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (বাক্বারাহ ৩১)। জ্ঞানই সবকিছুর ভিত্তিমূল। জ্ঞানের আলোকেই মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। জ্ঞান তথা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতিসত্তা। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হ’ল শিক্ষা। জাতীয় আশা-আকাঙ্খা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা কেবলমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণও শিক্ষা।

কোন জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হ’লে সেই জাতির লোকদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যখন তারা সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি হবে তখনই একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সাধন সম্ভব। মহানবী (ছাঃ) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাতিকে একটি বিশ্ববিজয়ী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। আর এজন্য তিনি হেরা পর্বতের চূড়া থেকে নেমে আসা ইসলামের সর্বপ্রথম বাণী ‘ইক্বরা’র পথ ধরেই সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন।

প্রথম ওহী ‘পড়ুন’ :

* اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَق

পড়ো তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ।

অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মের আগমনে পৃথিবীবাসী মানুষের জন্য জাগতিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত হয়েছে। ইসলামের তথা, আল কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত বাণীটিই হচ্ছে- اقرأ অর্থাৎ, পড়ুন। এখান থেকে অনুধাবন করা যায়, ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য জ্ঞানের দ্বার কিভাবে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। নিম্নে আলেমদের মর্যাদা বিস্তারিত তুলে ধরা হলোঃ

(১) আলেম ও জাহেলের মধ্যে পার্থক্য : ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নেয়ামত। যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না তার কি সমান?’ (যুমার ৩৯/৯)। তিনি অন্যত্র বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ ‘বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হ’তে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হ’তে পারে?’ (রা‘দ ১৩/১৬)

(২) আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী : নবী-রাসূলগণ মানব সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী সর্বোত্তম মানুষ। তাই আলেমদের সবচেয়ে বড় মর্যাদা হ’ল, রাসূল (সাঃ) তাঁদেরকে নবীগণের উত্তরাধিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا، وَلَا دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ، ‘আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামকে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তারা রেখে গেছেন কেবল ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। [ইবনু মাজাহ ২/২২৩; তিরমিযী হা/২৬০৬]

(৩) আলেমগণ দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও প্রভূত কল্যাণের অধিকারী : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’।[বুখারী হা/৭১]  অতএব মহান আল্লাহ যার কল্যাণ চান, যাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করতে চান, তাঁকেই কেবল তিনি আলেম হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।

আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)

তিনি আরো বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্তুতঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)

(৪) প্রকৃত আলেমের জন্য জান্নাতের পথ সহজ হয়ে যায় : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, اَلْخَلْقُ كُلُّهُمْ يُصَلُّونَ على مُعَلِّمِ الخَيْرِ حَتَّى حِيْتَانِ البَحْرِ ‘মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য সমগ্র সৃষ্টি, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্তও তার জন্য দো‘আ করে’। [সিলসিলা ছহীহাহ: ১৮৫২]

(৫) আলেমের মর্যাদা আবেদের চেয়ে বেশী : রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ ‘আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ’। [মিশকাত হা/২১২]

ক্বাযী আয়ায বলেন, এই তুলনার কারণ এই যে, নক্ষত্রের আলো দ্বারা সে কেবল নিজেই আলোকিত হয়। কিন্তু চাঁদের আলো নিজেকে ছাড়াও অন্যকে আলোকিত করে। অনুরূপভাবে আবেদ তার ইবাদত দ্বারা কেবল নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। কিন্তু আলেম তার ইল্ম দ্বারা নিজে যেমন উপকৃত হন, তেমনি অন্যকে উপকৃত করে থাকেন। আলেম উক্ত নূর লাভ করেন রাসূল (সাঃ) থেকে। যেমন চন্দ্র জ্যোতি লাভ করে থাকে সূর্য থেকে। আর সূর্য কিরণ লাভ করে আল্লাহ থেকে। একইভাবে রাসূল (সাঃ) ‘অহি’ লাভ করে থাকেন আল্লাহ থেকে’ (মিরক্বাত)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَصْدٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ ‘অধিক ইবাদত করার চেয়ে অধিক ইলম অর্জন করা উত্তম। [মিশকাত হা/২৫৫]

আবূ উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূল (সাঃ) এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হ’ল। যাদের একজন আলেম অপরজন আবেদ। তখন তিনি বলেন, فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের উপর’। [তিরমিযী হা/২৬৮৫]

(৬) ইলম বিতরণকারী আমলকারীর সমপরিমাণ নেকী লাভ করবেন : একজন আলেম লেখনী, শিক্ষাদান বা বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। ফলে যত মানুষ তার মাধ্যমে হেদায়াত লাভ করবে, নেকীর কাজের দিশা পাবে এবং তদনুযায়ী আমল করে সওয়াব অর্জন করবে, উক্ত আলেম তাদের সমপরিমাণ নেকী লাভে ধন্য হবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهِ، لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ ‘যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করবে। তবে আমলকারীর ছওয়াব থেকে সামান্যতমও কমানো হবে না’। [ইবনু মাজাহ হা/২৪০]

এমনকি মৃত্যুর পরেও তিনি উক্ত নেকী লাভ করতে থাকবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ: إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তিনটি আমল ব্যতীত তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। ১. প্রবাহমান দান ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং ৩. নেক সন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’। [মুসলিম হা/১৬৩১]

আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য: নিম্নে ওলামায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) আল্লাহভীরু হওয়া : একজন আলেমের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তিনি আল্লাহভীরু হবেন। আল্লাহভীতি ছাড়া পাহাড় পরিমাণ জ্ঞান কোনই কাজে আসবে না। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মূলতঃ আলেমরাই তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ জানাই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জন হ’ল আল্লাহভীতি অর্জন করা। [ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১৪৭ পৃঃ]

জনৈক আরবী কবি বলেন,لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس ‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হতো। [মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী, ১/১৩]

জ্ঞানের অহংকার সবচেয়ে বড় অহংকার। তাই তাক্বওয়া বিহীন ইলম ব্যক্তির আত্মগরিমাকে পরিপুষ্ট করে। ফলে ঐ ইলম তার ক্ষতির কারণ হয়। অন্যদিকে তাক্বওয়াশীল আলেম সর্বদা বিনয়ী হন। ফৎওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তারা কখনো সর্বজান্তা ভাব প্রকাশ করেন না। বরং প্রতিটি আমলের ব্যাপারে, প্রতিটি ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। ভুল হয়ে যাওয়ার ভয়ে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন। তাই দেখা যায় যে ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ) বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হওয়া সত্বেও তাঁকে ৪৮টি প্রশ্ন করা হলে ৩২টির জবাবে তিনি বলেন, لاَ أدْرِيْ ‘আমি জানি না’। [কুরতুবী, বাক্বারাহ ৩২ আয়াতের তাফসীর]

(২) দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা : আলেমে দ্বীনের দায়িত্ব হ’ল মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানের পূর্বে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণ করা। ইমাম বুখারী (রহঃ) ছহীহ বুখারীতে ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন করা’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন।[বুখারী পৃঃ ১৬]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَنْ عَلِمَ فَلْيَقُلْ، وَمَنْ لَمْ يَعْلَمْ فَلْيَقُلِ اللهُ أَعْلَمُ. فَإِنَّ مِنَ الْعِلْمِ أَنْ يَقُولَ لِمَا لاَ يَعْلَمُ لاَ أَعْلَمُ ‘যে জানে সে যেন তাই বলে, আর যে জানে না সে যেন বলে, আল্লাহ সর্বাধিক অবগত। কারণ এটাও একটা জ্ঞান যে, যার যে বিষয় জানা নেই সে বলবে, আমি এ বিষয়ে জানি না। [বুখারী হা/৪৭৭৪; মুসলিম হা/২৭৯৮]

ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, مَن قال لاَ أدْرِيْ فقد أحرز نصفَ العلم ‘যে বলবে, আমি জানি না। সে অর্ধেক জ্ঞান অর্জন করল’। [আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন, ১/৩১৪]

(৩) কুরআন ও ছহীহ হাদীসের সিদ্ধান্তের নিরঙ্কুশ অনুসরণ :

আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِيْنًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)

অন্যত্র তিনি বলেন,فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا- ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহীহ হাদীস পেলেই তা গ্রহণ করা। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, إذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ، ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, যেনো সেটাই আমার মাযহাব’। [ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার ১/১৬৭] সাথে সাথে সকল প্রকার যঈফ ও জাল হাদীছ   থেকে সর্বোতভাবে দূরে থাকা। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করল, সে তার নিজের স্থান জাহান্নামে করে নিল’। [বুখারী হা/৬১৯৭]

(৪) নবী-রাসূলগণের দাওয়াতী নীতি অনুসরণ করা : আলেমে দ্বীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল দাওয়াতের ক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণের নীতি অনুসরণ করা। নবী-রাসূলগণ মূলতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিরক বিমুক্ত তাওহীদ বিশ্বাস ও বিদ‘আতমুক্ত আমলের দিকে মানুষকে আহবান করেছেন। আলেমগণ মানুষকে সেদিকেই আহবান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ- ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকটে আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ ‘আর আমরা তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা আমার ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/৮২৫)

মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনে প্রেরণকালে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকটে যাচ্ছ। সুতরাং প্রথমে তাদেরকে এই সাক্ষ্য প্রদানের দাওয়াত দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল। যদি তারা তোমার এ দাওয়াত মেনে নেয় তাহ’লে তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহ দিন-রাতে তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যদি তারা তোমার একথাও মেনে নেয়, তখন তাদের জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হবে’। [বুখারী হা/১৪৫৮; মুসলিম হা/১৯]

(৫) সালাফে সালেহীনের পদাংক অনুসরণ করা : দ্বীনী বিধি-বিধান সাব্যস্তের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামকে সালাফগণের অনুসরণ করতে হবে। তথা শারঈ কোন বিষয়ে জানা ও বোঝার জন্য কুরআন ও ছহীহ হাদীসকে সামনে রাখার সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরাম কিভাবে সেটি ব্যাখ্যা করেছেন এবং কিভাবে বুঝেছেন তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

কারণ সাহাবায়ে কেরাম শারঈ বিধি-বিধান সরাসরি রাসূল (ছাঃ) থেকে গ্রহণ করেছেন, যথাযথভাবে অনুধাবন করেছেন এবং নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তারাই রাসূল (সাঃ)-এর পর উম্মতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِىْ قَرْنِىْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ‘আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবেঈগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈন)। [বুখারী হা/৩৬৫০; মুসলিম হা/২৫৩৩]

(৬) ইখলাস বজায় রাখা : আলেম দ্বীনের সকল কর্ম সকল ইবাদত হবে ইখলাছপূর্ণ। কারণ ইখলাছবিহীন কোন আমল আল্লাহ কবুল করেন না। আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّيْنَ، ‘বল, আমি আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি আল্লাহর ইবাদত করি একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/১১)

রাসূল (সাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পাদিত ও তার সন্তুষ্টি কামনায় নিবেদিত আমল বৈ কবুল করেন না। [নাসাঈ হা/৩১৪০]

অতএব দ্বীনী ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্ণ ইখলাস বজায় রাখা আবশ্যক। কেউ যদি দুনিয়াবী কোন স্বার্থসিদ্ধি বা সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের জন্য ইলম অন্বেষণ করে, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ، ‘যে ব্যক্তি আলেমদের উপর গৌরব করার জন্য অথবা মূর্খদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’। [তিরমিযী হা/২৬৫৪]

তিনি বলেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ‘যে ইলম বা জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, কেউ সে জ্ঞান পার্থিব স্বার্থোদ্ধারের অভিপ্রায়ে অর্জন করলে ক্বিয়ামতের দিন সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’। [আহমাদ ৮২৫২]

(৭) ইলম অনুযায়ী আমল করা : ইলম অনুযায়ী আমল করা একজন আলেমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ তারা মানুষকে সৎ পথের দিকে আহবান করেন এবং অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করেন। এক্ষণে তারা যদি নিজেরাই তা পালন না করেন, তবে তাদের পরিণতি কত ভয়াবহ হ’তে পারে তা রাসূল (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। যেখানে তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন জনৈক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে তার নাড়ী-ভূড়ি বেরিয়ে যাবে। তখন সে ঐ নাড়ী-ভূড়ির চতুর্দিকে ঘুরতে থাকবে। যেমনভাবে গাধা ঘানির চারদিকে ঘুরে থাকে। এ অবস্থা দেখে জাহান্নামবাসীরা তার চার পাশে জড়ো হবে ও তাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে অমুক! তোমার এ কি অবস্থা? তুমি না সর্বদা আমাদেরকে ভাল কাজের উপদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে? তখন লোকটি জবাবে বলবে, আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু নিজে তা করতাম না। আমি তোমাদেরকে মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতাম; কিন্তু আমি নিজেই সে কাজ করতাম। [মিশকাত হা/৫১৩৯]

সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, যখন কোন মুমিন তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, তখন তার ইলম তাকে তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতার দিকে পথ প্রদর্শন করবে। আর যখন সে তাক্বওয়া অবলম্বন করবে, তখন তার অন্তর আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে যুক্ত হবে। [হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫]

(৮) হকের উপর অবিচল থাকা : আল্লাহ বলেন,الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلاَ تَكُنْ مِنَ الْمُمْتَرِينَ ‘সত্য কেবল তোমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে আসে। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/৬০)। আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য হ’ল হকের উপর অটল থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপর বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’। [মুসলিম হা/১৯২০]

(৯) উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া : আলেমগণ সর্বসাধারণের জন্য আদর্শ মানুষ হিসাবে গণ্য হন। তাই একজন আলেমের জন্য উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া আবশ্যক। সেকারণ আল্লাহ  রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম’। [বুখারী হা/৩৫৫৯]

আলেমদের কখনোই কর্কশভাষী, অশ্লীলভাষী, বদমেজাজী হওয়া চলবে না। সেকারণ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আপনি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার সংসর্গ হতে দূরে সরে যেত (আলে ইমরান ১৫৯)

রাসুল (সাঃ) বলেন, إِنَّ أَثْقَلَ شَيْءٍ يُوْضَعُ فِىْ مِيْزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُلُقٌ حَسَنٌ وَإِنَّ اللهَ يُبْغِضُ الْفَاحِشَ الْبَذِيءَ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে আমলটি রাখা হবে তা হ’ল উত্তম চরিত্র। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীলভাষী দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন। [তিরমিযী হা/২০০২]

জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, আমাকে নছীহত করুন। তিনি বললেন, لاَ تَغْضَبْ ‘তুমি রাগ কর না’। তিনি কয়েকবার একথাটি বললেন। [বুখারী হা/৬১১৬]

(১০) সহনশীল হওয়া : ওলামায়ে দ্বীনকে অবশ্যই ধৈর্যশীল, সহনশীল ও ঠান্ডা মাথার অধিকারী হ’তে হবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) আব্দুল কায়েস গোত্রের নেতা, আশাজ্জ মুনযির ইবনু আয়েযকে বললেন,إِنَّ فِيْكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالأَنَاةُ، ‘তোমাদের মধ্যে এমন দু’টি ভাল গুণ রয়েছে, যাকে আল্লাহ পসন্দ করেন। তা হ’ল সহনশীলতা ও ধীর-স্থিরতা’। [মিশকাত হা/৫০৫৪]

(১১) লজ্জাশীল ও নম্র হওয়া : ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِى إِلاَّ بِخَيْرٍ ‘লজ্জা কল্যাণ বৈ কিছুই আনয়ন করে না’। তিনি বলেন, مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ ‘যাকে কোমলতা ও নম্রতা হ’তে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়’। [মুসলিম হা/২৫৯২]

(১২) নিজের বিরুদ্ধে হলেও সর্বদা হক কথা বলা : আলেমগণ সর্বদা হকের পথের দিশারী হবেন। যেমন কোন বক্তব্য বা ফৎওয়া প্রদানের পর পরবর্তীতে যদি তা ভুল প্রমাণিত হয়, তবে তা থেকে ফিরে আসা এবং ভুল স্বীকার করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান একজন আলেমের জন্য আবশ্যক। এক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার জন্য ইলম গোপন করা, জেনেশুনে ভুল ফৎওয়া প্রদান করা চরম অন্যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ يَعْلَمُهُ فَكَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ، ‘কাউকে তার জ্ঞাত কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে যদি সে তা গোপন রাখে, ক্বিয়ামতের দিন তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেওয়া হবে’। [আহমাদ ২/৭৮৮৩]

শিক্ষাঃ

১. আলেমদের মর্যাদা অনেক বেশি যদি তারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন করে।
২. আলেমরা নবীদের উত্তরসূরী তাই তাতের উচিত প্রচলিত জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত মানুষদের জান্নাতমুখী করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো।
৩. পৃথিবীর কোন লোভ লালসায় আলেমদের আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। এতে করে তাদের জবাবদিহিতা কিয়ামতেরদিন অত্যন্ত কঠিন হবে।

 

Post a Comment

0 Comments

Close Menu