সুরা পরিচিতিঃ
সূরার ক্রম- ৩
অবতীর্ণ- মাদানী
নামের অর্থ- ইমরানের পরিবার’
মোট আয়াত সংখ্যা- ২০০
পারা নং- ৩ পারা(১-৯১), ৪ পারা(৯২-২০০)
মোট রুকুর সংখ্যা- ২০
সিজদাহ সংখ্যা- নেই
পূর্ববর্তী সূরা- সূরা বাকারা
পরবর্তী সূরা- সূরা নিসা
নামকরণঃ
এই সূরার ৩৩ নং আয়াত
اِنَّ اللّٰهَ اصْطَفٰۤى اٰدَمَ وَ نُوْحًا وَّ اٰلَ اِبْرٰهِیْمَ وَ اٰلَ عِمْرٰنَ عَلَى الْعٰلَمِیْنَۙ
(আল্লাহ্
আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরদেরকে সমগ্র বিশ্ববাসীর ওপর
প্রাধান্য দিয়ে মনোনীত করেছিলেন) এখানে ‘‘আলে-ইমরান’’ বা
‘ইমরানের বংশধরদের’ কথা বলা হয়েছে । একেই আলামত হিসেবে এর নাম গণ্য করে
সুরার নামকরণ করা হয়েছে। ইমরান হলেন ঈসা (আ.) এর নানা। মরিয়ম আঃ এর বাবা।
ইমরান আঃ এর স্ত্রীর নাম হান্না বিনতে ফাকুজ। হান্নার তার বোন বোন উশা
বিনতে ফাকুজ হলেন জাকারিয়া আঃ এর স্ত্রী। যিনি ইয়াহিয়া আঃ এর বাবা এবং
মরিয়ম আঃ এর খালু। এই আয়াতে নবীদের শাজেরা (সিলসিলা) বর্ণনা করা হয়েছে।
একটা হাদিসে নবীদের সংখ্যা পাওয়া যায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার আর রাসুলদের সংখ্যা
৩১৩ (মোট সাহাবীর সংখ্যা ও বদরী সাহাবীর সংখ্যার সমান)। এই হাদীস মাওলানা
মওদুদী তার তাফসীরে এনেছেন কিন্তু অধিকাংশ হাদীস মোতাবেক নবীদের সংখ্যা
অজানা। তবে মাওলানা খুব শক্ত দলীল ছাড়া রেফারেন্স টানেন না।
নাযিল হওয়ার সময়কালঃ
১. প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু হয়ে ৩২ নং আয়াত পর্যন্ত চলেছে এবং এটি সম্ভবত বদর যুদ্ধের নিকটবর্তী সময়ে নাযিল হয়।
২.
দ্বিতীয় ভাষণটি ৩৩ নং আয়াত থেকে শুরু হয়ে ৬৩ নং আয়াতে গিয়ে শেষ
হয়েছে (৬ষ্ঠ রুকুর শেষ পর্যন্ত)। ৯ম হিজরীতে নাজরানের প্রতিনিধি দলের
আগমনকালে এটি নাযিল হয়।
৩. তৃতীয় ভাষণটি সপ্তম রুকূ’র শুরু থেকে নিয়ে দ্বাদশ রুকূ’র শেষ অব্দি চলেছে। প্রথম ভাষণের সাথে সাথেই এটি নাযিল হয়।
৪. চতুর্থ ভাষণটি ত্রয়োদশ রুকূ’ থেকে শুরু করে সূরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। ওহোদ যুদ্ধের পর এটি নাযিল হয়।
কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ঃ
(১) সূরায় বিশেষ করে দু’টি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রথম, আহলী কিতাব
(ইহুদী ও খৃস্টান) ও দ্বিতীয়, যারা মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান এনেছিল।
(২) সূরা বাকারায় ইসলামের বাণী প্রচারের যে ধারা শুরু করা হয়েছিল প্রথম দলটির কাছে সেই একই ধারায় প্রচার আরো জোরালো করা হয়েছে।
(৩) তাদের আকীদাগত ভ্রষ্টতা ও চারিত্রিক দুষ্কৃতি সম্পর্কে সর্তক করা হয়েছে।
(৪) রসূল (স.) ও কুরআন এমন এক দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছে যার দাওয়াত পূর্ববর্তী ১ লাখ ২৪ হাজার পয়গাম্বর দিয়েছেন।
(৫) দ্বিতীয় দলটিকে শ্রেষ্ঠতম দলের মর্যাদা, সত্যের পতাকাবাহী ও বিশ্বমানবতার সংস্কার ও সংশোধনের দায়িত্ব দান করা হয়েছে।
(৬)
পূর্ববর্তী উম্মতদের ধর্মীয় ও চারিত্রিক অধঃপতনের ভয়াবহ চিত্র দেখিয়ে
তাকে তাদের পদাংক অনুসরণ করা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছিল।
(৭)
আহ্লি কিতাব ও মুনাফিক মুসলমান আল্লাহর পথে নানা প্রকার বাধা বিপত্তি
সৃষ্টি করছে তাদের সাথে কি আচরণ করবে, তাও তাকে জানানো হয়েছে।
(৮) ওহুদ যুদ্ধে তার মধ্যে যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল তা দূর করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
(৯) এটি সূরা বাকারার একেবারেই পরিশিষ্ট মনে হচ্ছে।
ঐতিহাসিক পটভুমিঃ
(১) বদর যুদ্ধের মুসলমানদের কম সংখ্যক লোকের বিজয়ের সফলতা দেখে মুশরিক,
মুনাফিক, আহলে কিতাব সবাই ঐক্যজোট হয়েছে মুসলমানদের পরাভূত করতে। অথচ
মুশরিকদের চেয়ে মুসলমানরা বেশি আহলে কিতাবদের বেশি কাছের হওয়ার কথা ছিল।
(২)
ওহুদ যুদ্ধের সাময়িক পরাজয় দেখে নানান পর্যালোচনা মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন
দিক থেকে শুরু হলো। মুসলমানের নিজের মাঝেও ত্রুটিগুলো প্রকাশিত হলো।
পাশাপাশি কারা কারা আগামী দিনের জন্য সবচেয়ে পরীক্ষিত তাদেরও বেঁচে নেয়া
সম্ভব হলো।
এই সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেক বিষয়ের উপর আল্লাহর ওহীর দালীল প্রয়োজন ছিল।
আরবী ও অনুবাদঃ
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা তৈরী করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য। [133]
যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন। [134]
তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে-শুনে তাই করতে থাকে না। [135]
তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা কাজ করে তাদের জন্য কতইনা চমৎকার প্রতিদান। [136]
তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। [137]
এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী। [138]
আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে। [139]
তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। [140]
আর এ কারণে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধবংস করে দিতে চান। [141]
তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল। [142]
আর তোমরা তো মৃত্যু আসার আগেই মরণ কামনা করতে, কাজেই এখন তো তোমরা তা চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ। [143]
আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন। [144]
আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না-সেজন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ যে লোক দুনিয়ায় বিনিময় কামনা করবে, আমি তাকে তা দুনিয়াতেই দান করব। পক্ষান্তরে-যে লোক আখেরাতে বিনিময় কামনা করবে, তা থেকে আমি তাকে তাই দেবো। আর যারা কৃতজ্ঞ তাদেরকে আমি প্রতিদান দেবো [145]
আর বহু নবী ছিলেন, যাঁদের সঙ্গী-সাথীরা তাঁদের অনুবর্তী হয়ে জেহাদ করেছে; আল্লাহর পথে-তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্তও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা সবর করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। [146]
তারা আর কিছুই বলেনি-শুধু বলেছে, হে আমাদের পালনকর্তা! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদিগকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদিগকে সাহায্য কর। [147]
অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখেরাতের সওয়াব। আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। [148]
শিক্ষনীয় দিকঃ
১. জান্নাত এক বিস্তৃত স্থানের নাম। এটি অর্জন করতে আল্লাহ ক্ষমা লাভের বিকল্প নেই।
২. মুমিনদের সর্বাবস্থায় আল্লাহ পথে ব্যয় করার মানসিকতা থাকা উচিৎ।
৩. ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোন পাপ করে ফেললে আল্লাহ কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।
৪. আল্লাহভীরু মানুষদের জন্য আল্লাহ পৃথিবীতে নানা নিদর্শন রেখেছেন, যা থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারে।
৫. আল্লাহ তার কিছু বান্দার কুরবানীর বিনিময়ে কাফিরদের ধ্বংস করবেন। এ ব্যাপারে মুমিনদের হতাশ না হয়ে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা উচিৎ।
৬. আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেই জান্নাত দান করবেন যারা জিহাদে সম্পৃক্ত হয়ে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণ করে লড়ে যায়।
৭. দায়িত্বশীলের অনুপস্থিতি মুসলমানের কখনো দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে না।
৮. সৎকর্মশীলদের উচিৎ আল্লাহর কাছে দৃঢ়তা ও সাহায্য কামনা করা, তাহলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হবে।
0 Comments